কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন
ফল মানবজাতির জন্য প্রকৃতির অমূল্য উপহার। বন্য পরিবেশ থেকে আদিম মানুষ যখন স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে তখন তাদের পছন্দের প্রথম খাবার ছিল ফল। বাংলাদেশের গ্রীষ্ম ও অবগ্রীষ্মমÐলীয় আবহাওয়া ফল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দেশের উৎপাদন বিবেচনায় গ্রীষ্মকাল হলো ফলের মৌসুম। প্রায় ৭০ রকমের ফল জন্মে থাকে এ দেশে; যে সব আবাদি ফল উৎপাদিত হয় তার প্রায় ৫৪% বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ এ চার মাসেই পাওয়া যায়। এ সময় আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গি, আনারস, আমলকী, আতা, করমচা, জামরুল, বেল, গাব, কাঁচা তালসহ আরো অনেক ফল পাওয়া যায়। বাকি ৪৬% ফল পাওয়া যায় অন্য ৮ মাসে। তখন ফলের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় অনেক কম থাকে। কলা সারা বছরই পাওয়া যায়। পেয়ারাও প্রায় সারা বছরের ফল হয়ে গেছে। ভিটামিন, খনিজ পদার্থ এবং আঁশসমৃদ্ধ কিছু ফল বাংলাদেশে সহজেই উৎপাদন হয়, যেমনÑ নারিকেল, আমড়া, কুল, বরই, মাল্টা, কমলা, আমলকী, কামরাঙা, জাম্বুরা, বিলিম্বি, ডালিম, তাল, লটকন, কদবেল, অরবরই, চুকুর, করমচা, কাউ, সফেদা, কাঠলিচু, সাতকরা, গন্ধরাজ লেবু, কাগজি লেবু, জারা লেবু, গোলাপজাম, চালতা, টিপা ফল, ডেউয়া, ডুমুর, ডেফল, নোনা, ফলসা, আঁশফল, বেতফল, বৈঁচি, পানিফল, লংগান, আতা, শরিফা ইত্যাদি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশের মানুষের দানাজাতীয় শস্য গ্রহণের পরিমাণ ৪১৬ গ্রাম থেকে নেমে এসেছে ৩৬৭ গ্রামে, আবার মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে, যা ইতিবাচক (তথ্যসূত্র. চৎবষরসরহধৎু ৎবঢ়ড়ৎঃ ড়হ ঐড়ঁংবযড়ষফ ওহপড়সব ধহফ ঊীঢ়বহফরঃঁৎব ঝঁৎাবু-২০১৬, ঐওঊঝ ২০১৬)।
ফল গ্রহণের পরিমাণ, নিচের ছক থেকে সহজই পাওয়া যায় (গ্রাম/মাথাপিছু/প্রতিদিন)-
সূত্র : ঐওঊঝ-২০১৬, ইইঝ
দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় কৃষি ক্ষেত্রের অবিশ্বাস্য উন্নতি হয়ে যা বিশ্বে দৃষ্টান্ত। মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উন্নয়নশীল দেশটিতে এখন ১৬ কোটিরও বেশি লোকের বসবাস। যা কিনা সমগ্র বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। এ দেশেই সবচেয়ে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়েছে কৃষি খাতে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমির বিপরীতমুখী চাপ সত্তে¡ও বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যশস্য উৎপাদন ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়েছে। ফলের উৎপাদনও সমানতালে এগিয়ে চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন বিষয়ক প্রতিবেদন হতে জানা যায় যে, বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে। মোট ফল উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে ২৮তম স্থানে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে, দেশে আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা ও আনারসের মতো দেশি ফল উৎপাদন দ্রæত হারে বাড়ছে। সংস্থাটির ২০১৫ সালের প্রধান ফসলের পরিসংখ্যান বিষয়ক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে ১৮ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং উৎপাদনও বাড়ছে। বিবিএস এর হিসাবে গত বছরগুলোতে দেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে পেয়ারার। যার প্রভাব এবার বাজারেও পাওয়া গেছে। এই ফলটি এবার সারা বছর পাওয়া গেছে। বলা যায় পেয়ারা চাষে দেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা ডিএই’র হিসেবে দেশে ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রতি বছর ফল উৎপাদন প্রায় ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। আম, পেয়ারা ও কুল বা বরইয়ের বেশ কয়েকটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গত পাঁচ বছরে ৮৪টি ফলের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। ডিএই এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমের ফলে হেক্টরপ্রতি ফলন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বারি-৩ আম বা আম্রপালির মতো জাতগুলো দেশের তিন পার্বত্য জেলায় ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। থাই পেয়ারা ও বারি-৮ জাতের পেয়ারার সম্প্রসারণ ব্যাপকভাবে হয়েছে বলেই দেশে ফলের উৎপাদন প্রতি বছর প্রায় ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত আট বছরে আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা ও আনারসের মতো দেশি প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফল উৎপাদনও দ্রæতহারে বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। বিবিএস এর প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ১৮ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং উৎপাদন বাড়ছে।
বিবিএসের হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে প্রায় ২ লাখ টন লিচু, ৪ লাখ ৭০ হাজার টন পেঁপে, ৪০ হাজার টন কমলা, ৩ লাখ ৭০ হাজার টন আনারস ও ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কুল উৎপাদিত হয়েছে। আর মোট ফল উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ কোটি টন। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে বর্তমানে ৪৫ প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মোট ১ কোটি টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেড়েছে আমের উৎপাদন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছিল ১২ লাখ ৫০ হাজার টন। আর এ বছর তা বেড়ে ১৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে।
উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৪ এবং ২০১৪ থেকে চলমান তৃতীয় মেয়াদ অবধি তার দূরদর্শী নেতৃত্বে গঠিত সরকার বাস্তবসম্মত কৃষিনীতি এবং তদানুযায়ী বাজেটসহ অন্যান্য কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। দেশকে কৃষি উন্নয়নের জন্য বিশ্বে এক রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম (১৯৯৬-২০০১) মেয়াদেই কৃষিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন দেশের আরেক মাটি মানুষের রাজনীতিক ও বাংলার অগ্নিকন্যা খ্যাত মতিয়া চৌধুরীকে। তিনি তার সততা, জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়নে সমর্থ হন। সেই সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন করে দেশকে দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সমর্থ হন।
বর্তমান সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় দেশে ফলের প্রচুর সরবরাহ আছে বলেই জনসাধারণ ইচ্ছামতো ফল খেতে পারছেন। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণ ফল খাওয়া দরকার সে পরিমাণ ফল প্রকৃতপক্ষে দেশের সব মানুষ খাচ্ছেন না। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের ফাস্টফুড বা কৃত্রিম জুসের প্রতি আসক্তি অনেক বেশি। যার জন্য পুষ্টিহীনতায় বা স্থুলতায় ভুগছে উল্লেখযোগ্য নাগরিক।
খাদ্য গ্রহণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম হয়ে বেঁচে থাকা। যে কোনো খাবার দিয়ে পেট ভরানো যায় সত্য কিন্তু এতে দেহের পুষ্টির চাহিদা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হয় না, যার ফলে শিশুকালে শিশুরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। মানুষের খাদ্যকে মূলত তাপ ও শক্তিদায়ক, শরীর বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরক এবং রোগ প্রতিরোধক এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ফলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। ফল আমাদের শরীরে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে। ফলের মধ্যে রয়েছে দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদন। বিশেষত বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা উৎস হলো ফল। ফল রান্না ছাড়া সরাসরি খাওয়া যায়। আবার এসব পুষ্টি উপাদান অবিকৃত অবস্থায় দেহ কর্তৃক গৃহীত হয়, যা বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে স্বাভাবিক জীবনযাপনে মানুষকে সহযোগিতা করে।
শরীরে পুষ্টি উপাদান পাওয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক উপায় হচ্ছে ফল খাওয়া। এ জন্য প্রতিদিন এ দেশের প্রতিজন লোকের ফল খাওয়া দরকার ২০০-২৫০ গ্রাম। কিন্তু গড়ে খাওয়া হচ্ছে মাত্র ৩৫-৪০ গ্রাম। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় ফল গ্রহণের পরিমাণ অনেক কম। এই কম খাওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। প্রকৃত কারণ পুষ্টি জ্ঞানের অভাব। দৈনিক ১০০-১৫০ গ্রাম করে ফল খাবার মতো পর্যাপ্ততা দেশে আছে। শুধু পুষ্টি সম্পর্কে উদাসীনতার কারণে ফল গ্রহণের পরিমাণ কম। ফলশ্রæতিতে শুধু ভিটামিনের অভাবে দেশের মানুষ অনেক ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, যেমন ভিটামিন এ’র অভাবে ৮৮%, সি’র অভাবে ৮৭% বি’র অভাবে ৯৬%, ক্যালসিয়ামের অভাবে ৯৩% লোক প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো এসব ভিটামিনের অভাবজনিত রোগে ভুগছে। দেশের ৭০% পুরুষ এবং ৭৫% মহিলা আয়রন স্বল্পতায় ভুগছে। মহিলাদের মধ্যে জিংক স্বল্পতা ৫৭.৩০% এবং পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জিংক স্বল্পতা ৪৪%। এসব রোগ থেকে সহজেই মুক্ত থাকা যায় নিয়মিত ফল গ্রহণ করলে। তবে ফল খাওয়ারও নিয়ম আছে, যা মেনে চলতে পারলে দেহ বেশি পুষ্টি উপাদান শোষণ করতে পারে।
ড. স্টিফেন কার লিওন গবেষণা করে দেখেছেন যে, যে কোনো প্রধান আহারের আগে ফল খেলে বেশি পুষ্টি উপাদান শোষিত হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলগুলো পুষ্টিগুণে ভরপুর। আমরা যদি পুষ্টি শিক্ষায় ভালোভাবে শিক্ষা পেতে পারি তবে যে পরিমাণ ফল আমাদের দেশে উৎপাদন হয় বা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে তা উৎপাদন করে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাত করতে পারলে জনপুষ্টি অনেকখানিই পূরণ হতে পারে। এর ফলে উপযুক্ত মেধাসহ পরিপূর্ণ কর্মক্ষম মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে সকলে এবং দেশ পাবে সবদিকে শক্তিশালী এক জাতি। য়
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫